মাওবাদী নেতা হিডমার রোমাঞ্চকর কাহিনী

রোগা-পাতলা, দোহারা গড়ন। গোঁফের রেখাও ঠিকমতো ওঠেনি। ‘এ নাকি আবার গেরিলা বাহিনীর সর্দার!’ ছবিটা দেখে খুব একচোট হেসেছিলেন কয়েকজন পুলিশ-কর্তা। সেদিন অলক্ষ্যে হয়তো হেসেছিল আরও কেউ। রবিবার ছত্তিসগড়ে, সুকমা-বিজাপুর সীমানার জঙ্গল থেকে ২২ জন আধাসেনার দেহ উদ্ধারের পর জঙ্গলের আনাচে-কানাচে কি প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল সেদিনের সেই ব্যঙ্গের হাসি? কারণ, গোয়েন্দা সূত্র বলছে, আধাসামরিক বাহিনীকে কার্যত ট্র্যাপে ফেলে, জঙ্গলের অ্যাকশন এরিয়ায় এনে এ ভাবে মারার প্ল্যান আর কারও নয়, মাওবাদী নেতা মাডভি হিডমার, যার নিরীহ চেহারার ছবি ঘোল খাইয়েছিল আধাসেনা কর্তাদের!

হিডমার যে ছবি পুলিশসূত্রে সামনে এসেছে, তা বেশ পুরোনো। দেখলে মনে হয়, বয়স তখন কুড়ির কোঠায়। আর এখন? কেউ বলে হিডমার বয়স ৩৭-৩৮, আবার কারও মতে চল্লিশ পেরিয়েছে সেদিনের গোঁফের রেখা স্পষ্ট না হওয়া তরুণ। কিন্তু বয়সে কী-ই বা এসে যায়! প্রখর বুদ্ধি, প্ল্যান আর নাশকতার ছক সাজানোয় অনেক প্রবীণ মাওবাদী নেতাকে গোল দিতে পারে হিডমা। শুনবেন নাকি পার্বতী গ্রামের সেই রবিনহুডের গল্প?

বস্তারের মুরিয়া আদিবাসী সমাজের এই ছেলে ছোট থেকেই কেমন যেন উল্টোধারা। যা মিলছে, সেটুকুকে মুখ বুজে মেনে নেওয়ার বান্দা সে কোনও দিনই ছিল না। আর সেই প্রতিবাদী চরিত্রই একদিন প্রকাশ পেল অন্যভাবে। পার্বতী গ্রামের সেই হিডমালু ওরফে সন্তোষ নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় নাম লেখালো মাওবাদীদের দলে। সেখান থেকে আস্তে আস্তে মাওবাদী নেতা হিডমা হয়ে ওঠার গল্প। গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে ফিলিপিন্স পাড়ি দিয়েছিল বস্তারের এই ভূমিপুত্র। আর তার পর দেশে ফিরে ‘পিপলস লিবারেশন গেরিলা আর্মি’র এক নম্বর ব্যাটেলিয়নের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়া। ১৮০-২৫০ জন মাওবাদীর দল চলে হিডমার নেতৃত্বে আর সেখানে ট্রেনিং হয় সশস্ত্র মহিলা মাওবাদীদেরও। লোকে বলে, হিডমা নাকি ক্লাস টেন পাশ। অথচ, আদিবাসী ভাষার পাশাপাশি সাবলীল ইংরেজিতে কথা বলে সে! আরও অনেক আঞ্চলিক ভাষাই নাকি তার নখদর্পণে। হিডমার এই ভাষা দক্ষতা মনে করিয়ে দেয় মাওবাদী নেতা কিষেনজির কথা।

দক্ষতার কারণেই খুব অল্পদিনেই মাওবাদীদের দণ্ডকারণ্য স্পেশাল জোনাল কমিটিতে ঠাঁই পেয়েছিল হিডমা। সিপিআই (মাওবাদী) ‘সেন্ট্রাল কমিটি’র কনিষ্ঠ সদস্য হয়ে উঠেছিল অনায়াসেই। অসমর্থিত সূত্রের খবর, সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনেরও নাকি মাথায় বসানো হয়েছে হিডমাকে। সেদিনের সেই গোবেচারা মুখের আদিবাসী যুবক ক্রমেই পুলিশ-প্রশাসন, আধাসেনার মাথাব্যথা হয়ে উঠছিল। আর তাই তার মাথার দাম ধার্য হয়েছিল ৪০ লক্ষ টাকা!

কিন্তু এই বিপুল পুরস্কারমূল্যের লোভে কে তাকে ধরিয়ে দেবে? সুকমার দক্ষিণে পার্বতী গ্রামে এখনও পুলিশ-প্রশাসনের নয়, অলক্ষ্যে চলে হিডমার শাসন। পুলিশ বলে, ওই গ্রামের প্রতিটা কোণায় কোণায় নাকি হিডমার গুপ্তচর লুকিয়ে! এমন একজন ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ মাওবাদী টোকলাগুদাম গ্রামের জঙ্গলে ঘাঁটি গেড়েছে, তা জানতে পেরে আর দেরি করেনি আধা-সেনা। সুকমা-বিজাপুরে আধাসেনার নানা শাখা থেকে কমপক্ষে হাজার দুয়েক জওয়ানের দল শনিবার দুপুরে রওনা হয়েছিল জঙ্গলের পথে।


জঙ্গলের বেশ কিছুটা ভিতরে, মাওবাদী-জোনের কাছাকাছি পৌঁছতেই চারপাশের গাছ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে এল গুলি। মাওবাদীদের এই তিন দিক থেকে ঘিরে ধরে ‘U’ ধাঁচের আক্রমণের ধরন থেকেই আধাসেনার আধিকারিকদের ধারণা, জঙ্গলে হিডমার লুকিয়ে থাকার খবর চাউর করা আসলে পুরোটা হিডমারই ট্র্যাপ! শনিবার ওই জঙ্গলে হিডমা ছিল কি না, তা নিয়ে সংশয় থাকলেও সেদিন শ’চারেক মাওবাদী যে ভাবে আধাসেনার বিপুল বাহিনীর উপর আক্রমণ শানিয়েছে, তা হিডমারই ট্রেনিংয়ের ফল বলে মনে করছেন শীর্ষকর্তারা।

জানুয়ারি থেকে জুন, এই পাঁচ মাস গাছের পাতা ঝরে যায়। আর তাই এই সময়টাই ‘ট্যাকটিক্যাল কাউন্টার-অফেন্সিভ ক্যাম্পেন’ অর্থাৎ, আধাসেনার উপর প্রাণঘাতী হামলার সময় হিসেবে বেছে নেয় মাওবাদীরা। পাতা ঝরা গাছের মাঝে টার্গেট দেখা যায় স্পষ্ট। ঠিক যেমন সেদিন গাছের উপর থেকে ছুটে এসেছিল গুলি। আর ময়দান সাফ রাখতে টোকলাগুদাম-সহ আশেপাশের কয়েকটা গ্রাম আগেই খালি করে দিয়েছিল হিডমার দল।

ওডিশা, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং মহারাষ্ট্রের সীমানা ঘেঁষা এই সুকমা বরাবরই মাওবাদীদের শক্তঘাঁটি। এখানের গ্রামে হিডমার গেরিলা ব্যাটেলিয়নের ‘জনতার সরকার’ চলে, আর তাই গ্রাম ফাঁকা করে দিতে বললে ট্যাঁ-ফুঁ করে, কার সাধ্যি! সূত্রের খবর, শনিবারের যুদ্ধে মাওবাদীদের হাতে ছিল লাইট ওয়েট আগ্নেয়াস্ত্র। কিন্তু এমন অত্যাধুনিক অস্ত্র তাদের হাতে এল কী করে? গোয়েন্দা তথ্য বলছে, এর আগে আধা-সামরিক বাহিনীর উপর একাধিক হামলায় যে অস্ত্র মাওবাদীরা লুঠ করেছিল, সেই অস্ত্রই ব্যবহৃত হয়েছে শনিবারের সংঘর্ষে! শুধু তাই নয়, শনিবার সংঘর্ষের পর নিহত জওয়ানদের অস্ত্রও লুঠ করেছে তারা।

এটাও কি হিডমার স্ট্র্যাটেজি? আধাসেনার সূত্র বলছে, এই বস্তার এলাকায় যতগুলো প্রাণঘাতী মাওবাদী হামলা চলেছে, তার সবক’টার নেপথ্যে একটাই নাম ‘হিডমা’! ২০১৯-এ বিজেপি বিধায়ক ভীমা মাডভির খুন হোক বা ২০১০-এ ছত্তিসগড়ের দান্তেওয়াড়ায় আধা-সামরিক বাহিনীর কনভয়ে হামলা চালিয়ে ৭৫ জন জওয়ানের হত্যা, নেপথ্যে একজনই! ২০১৭ সালে সুকমায় মাওবাদী হানায় সিআরপিএফের ২৫ জওয়ান শহিদ হন, ২০১৩-এর মে মাসে ছত্তিসগড়ের দরভায় কংগ্রেস নেতাদের কনভয়ে মাওবাদী হানা চলে, যাতে প্রাণ যায় মহেন্দ্র কর্মা এবং নন্দ কুমার প্যাটেল-সহ ২৫ জন কংগ্রেস নেতার—এই সব হামলার পিছনে দোহারা চেহারার সেই তরুণ, পার্বতী গ্রামের ভূমিপুত্র হিডমা!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *