বাংলায় রাজ্যপাল বনাম রাজ্য সংঘাত তুঙ্গে

ক্ষমতার দুটি কেন্দ্র থাকলে খটাখটি লাগবেই। কখনও কখনও তা বড় নগ্ন হয়ে পড়ে। যেমন এখন পড়েছে আমাদের পশ্চিমবঙ্গে। নবান্ন ও রাজভবনের এই ভৌত দ্বন্দ্বে নাগরিক সমাজ সরব হয়ে উঠেছে ভার্চুয়াল ভুবনেও। বিশেষ করে এই করোনাকালে। রাজভবন বনাম নির্বাচিত সরকারের যে বিরোধ হতে পারে, তা নিয়ে কিন্তু ভারত রাষ্ট্রটির জন্ম মুহূর্ত থেকেই সন্দেহ ছিল। স্বাধীনতার পর কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে বিতর্কে যোগ দিয়ে অনেকেই সেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। যদিও তাঁদের মন্তব্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি তখন। এই না দেওয়ার পিছনে কোনও ধান্দা ছিল, এটা বলা যাবে না। আসলে তখন রাজনৈতিক বাস্তবতাটাই ছিল অন্যরকম, একটু সরল। তখন সবটাই ছিল কংগ্রেস -সে হিন্দু মহাসভা-ই হোক, স্বতন্ত্র পার্টি-ই হোক কিবা কমিউনিস্ট পার্টি-ই হোক। সবাই ভিন্ন নামে কংগ্রেস মানে, দেশপ্রেমী ও স্বদেশি। তাই তাঁরা ৫০ বছর পর বা ৭০ বছর পর কী হতে পারে, তা ধারণা করতে পারেননি বা আজকের ভাষায় বললে, প্রোজেক্ট করতে পারেননি। আমাদের রাজ্যে এই দুই কেন্দ্রের সঙ্কট প্রথম সারফেসে এল ১৯৬৭ সালে, যখন লাটসাহেবের বাড়ির সাহেব ছিলেন ধরম বীরা। আরও অনুধাবনের, তিনি এই রাজ্যের প্রথমরাজ্যপাল যিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী বা কংগ্রেসি নন, আইসিএস, পাক্কা আমলা। আর সেই শুরু, জগদীপ ধনখড় সেই ধারাই বয়ে চলেছেন।

রাজ্যপাল বনাম মন্ত্রিসভা, এই বিরোধটা দেখা যায় কেন্দ্র ও রাজ্যে একই দলের সরকার না থাকলেই। দেখা যায় রাজ্যপালরা যখন তখন বেরিয়ে আসেন রাজভবন থেকে। ১৯৬৭ সাল অজয় মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস বিরোধীরা সরকার গড়লেন। ইন্দিরা গান্ধী তখন প্রধানমন্ত্রী। রাজ্যপালকে কাজে লাগিয়ে সরকার ভাঙার খেলায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। তাঁরই কৌশলে কেরালার প্রথম সরকার তথা দেশের প্রথম কমিউনিস্ট সরকার, যার প্রধান ছিলেন ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদ, সেই সরকারকে মেয়াদ শেষ হওয়ার অনেক আগেই ১৯৫৯ সালে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। সেই ইন্দিরার আমলে পদ্মজা নাইডুর মেয়াদ শেষ হতে ১৯৬৭ সালের ১ জুন রাজভবনে প্রেরিত হলেন ধরম বীরা। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে নাকাল করতে রাজভবনের ফেন্সিংয়ের বাইরে খেলা শুরু হল। অজয় মুখোপাধ্যায়ের সরকার ৯ মাসও পূরণ করতে পারল না। ২১ নভেম্বর ইস্তফা দিলেন অজয় মুখোপাধ্যায়। জ্যোতি বসুরা রাজ্যপালকে বলেছিলেন, সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে কিনা, তা বিধানসভা ডেকে আস্থা ভোটে প্রমাণ করার সুযোগ দেওয়া হোক। ধরম বীরা শুনলেন না। বরখাস্ত করলেন প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারকে। তৈরি হল কংগ্রেসের সমর্থনে প্রফুল্ল ঘোষকে মুখ্যমন্ত্রী করে প্রগ্রেসিভ ডেমক্র্যাটিক ফ্রন্টের (পিডিএফ) সরকার।

মহারাষ্ট্রে শিবসেনা-এনসিপি-কংগ্রেসের জোট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরেকে ব্যতিব্যস্ত করতে রাজ্যপাল ভগৎ সিং কেশিয়ারি যাবতীয় চেষ্টা করে চলেছেন। পালঘাটে সাধু পিটিয়ে মারার ঘটনাই হোক, কিবা বিধান পরিষদে নির্বাচন হোক, সব বিষয়ই ঠাকরে বনাম কেশিয়ারি সংঘাত সারফেসে এসে যাচ্ছে। এমনকী, করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় রাজ্যপালের আচরণে তিতিবিরক্ত ঠাকরে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী মোদীকে ফোন করে অভিযোগ জানাতে বাধ্য হন। দক্ষিণের ছোট্ট রাজ্য পুদুচেরীতে কংগ্রেসের বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী নারায়ণস্বামীর অভিযোগ ছিল, তাঁকে ও তাঁর সরকারকে ফেলার জন্য যাবতীয় চেষ্টা রাজ্যপাল কিরণ বেদী করেছিলেন। তবে সবার সেরা জগদীপ ধনখড়। ‘পদ্মপাল’ হিসেবে যে ইমেজ তৈরি করেছেন, তাতে রাজ্যপাল পদের আর কোনও মর্যাদা রইল না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *