ছোটখাটো একটা গোল। পাতি বাংলায় যাকে বলে ‘শূন্য’। পরীক্ষার খাতায় নম্বরটা খুব একটা সুখকর না হলেও বেতনের অঙ্ক থেকে যদি একটা শূন্য কেটে নিই, কেমন লাগবে বলুন তো?
ভাবছেন নিশ্চয়ই, এ আবার কেমন হেঁয়ালি! না মশাই, একেবারেই হেঁয়ালি নয়। শূন্য বিষয়টা আদতে যতই কম ওজনদার হোক, অঙ্কশাস্ত্রে তার ওজন যে কতটা, তা ভালোই বোঝেন গণিতজ্ঞরা। আর তাই তো ‘শূন্য’ সৃষ্টির ইতিহাস নিয়ে এত কৌতূহল! ঠিক সেই কৌতূহলই প্রতি বছর বেশ কিছু গণিত আর ইতিহাস পিপাসুকে টেনে নিয়ে যায় গোয়ালিয়রের চতুর্ভুজ মন্দিরে!
আবার সব ঘেঁটে গেল তো? মনে মনে নিশ্চয়ই ভাবছেন, শূন্যের গল্পে আচমকা মন্দির এসে গেল কোথা থেকে? এ তো পুরো ‘ছিল রুমাল, হয়ে গেল বিড়াল’! আজ্ঞে না, এ বিষয়টা এতটাও ‘হযবরল’ নয়। আসুন তবে একটু বুঝিয়ে বলি।
মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়র দুর্গের ‘হাতি পুল’ (এলিফ্যান্ট গেট) দেখেছেন নিশ্চয়ই। মধ্যপ্রদেশে গেলে গাইডদের ট্যুরিস্ট স্পটের তালিকায় এলিফ্যান্ট গেট থাকবেই। কিন্তু সেই পুলে যাওয়ার পথে ‘চতুর্ভুজ মন্দির’টাকে ভালো করে দেখেছেন কখনও? না, চোখে পড়ার মতো চেহারা অবশ্য সে মন্দিরের নয়। বহু প্রাচীন, পুরোনো স্থাপত্যের সাদামাটা একটা বিষ্ণু মন্দির। তবে, হাতে ৫ মিনিট সময় থাকলে একটু দাঁড়িয়ে যান। মন্দিরের সামনেই বহু প্রাচীন এক শিলালিপি। ৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের এই শিলালিপি একটু কষ্ট করেই পড়তে হয়। আহামরি খুব কিছু লেখা নেই! ফুলের বাগান গড়ার জন্য ২৭০ হস্ত জমি দান করা হয়েছে, আর সঙ্গে প্রতিদিন ৫০টা করে মালা। দানের সেই বিবৃতির মধ্যে যেটা আপনার নজর কাড়বে, সেটা হল ২৭০ আর ৫০ সংখ্যা দু’টোর শূন্যের গঠন। সেখানে গোলাকার যে চিহ্ন দু’টি ব্যবহার করা হয়েছে, সেটাই ভারতে ‘শূন্য’ সংখ্যার সবচেয়ে পুরোনো লিখিত রূপ, আর বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় প্রাচীনতম!
এ বার রুমাল আর বিড়ালের হিসেবটা মিলল তো?
ইতিহাসের বহু প্রাচীন ও মূল্যবান এই শিলালিপি এ ভাবেই অনাদরে পড়ে রয়েছে গোয়ালিয়রের প্রাচীন মন্দিরের দোরগোড়ায়। যাঁরা জানেন, তাঁরা ‘হাতি পোলে’র ভিড়ে না গিয়ে এখানেই বেশ কিছুটা সময় কাটান। মন দিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন এই শিলালিপি। কিন্তু সে পর্যটকের সংখ্যা নেহাতই হাতে গোনা!
ব্যাবিলনীয় এবং চৈনিক সভ্যতায় ‘শূন্যতা’র ধারণা থাকলেও ভারতের গণিতজ্ঞরাই প্রথম এটিকে সংখ্যার রূপ দেন— একটি গোলাকার সংখ্যা। ব্যাবিলনীয়রা শূন্যতা বোঝাতো চিহ্ন দিয়ে আর চিনারা ব্যবহার করত স্পেস বা ফাঁকা জায়গা। ভারতের তৈরি গোলাকার ‘শূন্য’ অঙ্কশাস্ত্রের সব হিসেব-নিকেশকে অনেক সহজ করে দিল!
১৯৩১ সাল পর্যন্ত গোয়ালিয়রের এই ‘শূন্য’কেই বিশ্বে শূন্যের প্রাচীনতম শিলালিপি বলে গণ্য করা হত। কিন্তু কম্বোডিয়ার একটি আবিষ্কার সেই সম্মান কেড়ে নিল! ১৯৩১ সালে ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিক জর্জেস সোয়েডেস কম্বোডিয়ার সাম্বোরে পুরোনো একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে একটি শিলালিপি উদ্ধার করেন, যাতে গোলাকার শূন্যের উল্লেখ রয়েছে। সেটি ৬৮৩ খ্রিস্টাব্দের, অর্থাৎ গোয়ালিয়র শিলালিপির থেকে প্রায় ১৯২ বছরের পুরোনো! এটিকে রাখা হয় কম্বোডিয়ার ন্যাশনাল মিউজিয়ামে। কিন্তু ঘটনাচক্রে মিউজিয়াম থেকে খোয়া যায় শিলালিপি। প্রামাণ্য তথ্যের অভাবে গোয়ালিয়রের শূন্য তার হারানো গৌরব অর্থাৎ, বিশ্বের প্রাচীনতম শূন্যের শিলালিপির মর্যাদা ফিরে পায়।
কিন্তু সে সুখ বেশি দিন সইল না। ২০১৭-এর জানুয়ারিতে কম্বোডিয়ার ন্যাশনাল মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ জানাল, হারানো ‘শূন্য’ ফেরত পেয়েছে তারা। আর তাই, প্রাচীনতম শূন্য সম্বলিত সেই শিলালিপি শোভা পাবে সেখানের সংগ্রহশালায়। গোয়ালিয়রের শূন্য ফিরে গেল দ্বিতীয় স্থানে।
বিশ্বের প্রাচীনতম শূন্য হিসেবে কম্বোডিয়ার শিলালিপির গুরুত্ব অনেক বেশি, ঠিকই। কিন্তু গোয়ালিয়রের এই শূন্য শিলালিপির অবদানও ভারতের ইতিহাসে কিছু কম নয়। অথচ, প্রথম স্থানাধিকারী যেখানে মিউজিয়ামে পরম যত্নে, রাজকীয় মর্যাদায় শোভা পাচ্ছে, সেখানে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী পরম অযত্নে শায়িত বিষ্ণুমন্দিরের চাতালে। হাতি পুল থেকে সামান্য দূরে শায়িত ভারতের গণিত শাস্ত্রের ইতিহাসের এক অধ্যায়। কালের নিয়মে হয়তো ‘শূন্যে’ই বিলীন হয়ে যাবে একদিন!