চাঞ্চল্যকর তথ্য সিবিআইয়ের তরফে, কেষ্টর দিনে আয় ৩০ লক্ষ

জীবনের শুরুটা খুব সাধারণ ভাবে হলেও আজ তিনি কোটি কোটি টাকা সম্পত্তির মালিক৷ প্রথম জীবনে ছিলেন সামান্য মুদি দোকানি৷ খেলতেন ফুটবলও৷ পরে সে সব ছেড়ে বোলপুর বাজারে নিজের মাছের দোকান খেলেন তিনি৷ দিনের শেষে রোজগার হত বড় জোড় ৫০-৬০ টাকা।

সেখান থেকে বীরভূমের বেতাজ বাদশা৷ মাছের দোকান ছেড়ে রাজনীতির আঙিনায় পা রাখতেই বদলে যায় চিত্রটা। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে অনুব্রত মণ্ডলের উপার্জন। সময়ের স্রোতে তিনি পৌঁছে যান ক্ষমতার শিখরে৷ পাল্লা দিয়ে বাড়ে রোজগারও৷

শুধু তাই নয়, বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতির আয় পৌঁছয় সাধারণ মানুষের কল্পনার বাইরে। জানেন দিনে কত টাকা আয় করতেন কেষ্ট? দিনে প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা! গরু-কয়লা পাচার থেকে বেআইনি বালি-পাথর খাদান—বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসা থেকে এই বিপুল অঙ্কের টাকা এসে জমত কেষ্টর তহবিলে।

বীরভূমের ‘মুকুটহীন সম্রাট’-এর সম্পত্তির খোঁজে নেমে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ের হাতে। তদন্তকারীদের দাবি, এই বিপুল অর্থের একটা অংশ ‘দানধ্যানে’ খরচ করতেন তৃণমূলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা৷ বাকি টাকা গচ্ছিত রাখতেন সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ দেহরক্ষী এবং এক বিধায়কের কাছে।

তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতিকে গ্রেফতারের পর এখন সেই বিধায়কই সিবিআইয়ের ব়্যাডারে। তাঁর বিরুদ্ধে চলছি নথি জোগাড়ের কাজ৷ পর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণ হাতে এলেই তলব করা হবে ওই বিধায়ককে৷ তেমনটাই কেন্দ্রীয় সংস্থা সূত্রের খবর। 

গরু পাচার মামলার তদন্তে নেমে ইতিমধ্যেই তৃণমূলের দাপুটে নেতা অনুব্রত মণ্ডলের আয়ের উৎস খুঁজে ফেলেছে সিবিআই। বেনামে থাকা অগাধ সম্পত্তির নথিও এখন গোয়েন্দাদের হাতে। সিবিআই সূত্রে খবর, পাচার হওয়া গরু পিছু আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা ‘কমিশন’ ধার্য করে দিয়েছিলেন ‘বীরভূমের বাদশা’।

ঈদ-মহরমের মরশুমে সেটাই বেড়ে হত পাঁচ থেকে ছ’হাজার। কয়লার ক্ষেত্রে গাড়ি পিছু ১০ হাজার টাকা ছিল ‘ফিক্সড রেট’। এই ‘প্রোটেকশন মানি’ না দিয়ে বীরভূমের উপর দিয়ে গরু বা কয়লা কোনওটাই পাচার করা যেত না। অফিসাররা জানতে পেরেছেন, টাকা তোলার দু’টি পথ ছিল। এক, ইলামবাজারের পশুহাটের মালিক আব্দুল লতিফ খানের মাধ্যমে। যিনি অনুব্রত ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত৷ দ্বিতীয়ত, পাচার পথের সমস্ত থানায় দিতে হতো টোকেন মানি।

তদন্তে উঠে এসেছে গরু পাচারের ‘রুট’-এর তথ্যও। জানা গিয়েছে, ভিন রাজ্য থেকে গরু এসে জমা হত ইলামবাজারের পশু হাটে৷ সেখান থেকে দু’টি পথে পাচার করা হত গরু। একটি মাড়গ্রাম থেকে জঙ্গিপুর, রঘুনাথগঞ্জ, লালগোলা হয়ে বাংলাদেশ। অপরটি ইসলামপুর-রানিনগর ঘুরে পড়শি দেশে।

এর বাইরে আরও কিছু ‘রুট’ ছিল৷ সিবিআই গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন মোট ২৭টি থানা এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ছিল চোরা পথ। প্রতিটি এলাকায় পুলিশের সঙ্গে মাসিক চুক্তি করা ছিল পাচারকারীদের। এক একটি থানার জন্য মাসে বরাদ্দ থাকত ৬০ থেকে ৭০ লক্ষ টাকা।

এর মধ্যে ব্যতিক্রম ছিল মুর্শিদাবাদে সীমান্তের দু’টি থানা৷ এই দুই থানার জন্য মাসে ভেট যেত এক কোটি টাকা। বালি, পাথর এবং কয়লার ক্ষেত্রেও রেট বাঁধা ছিল। সবটাই চলত অনুব্রতর ‘উদারতায়’৷ সিবিআই সূত্রে খবর, গরু, কয়লা, বালি ও পাথরভর্তি গাড়ির নম্বর পাঠানো হতো অনুব্রতর ঘনিষ্ঠ দেহরক্ষী সায়গলের কাছে। মসৃণ ভাবে পাচার পর্ব সারতে পুলশি কর্তাদের তা আগাম জানিয়ে রাখা হত৷

এই কাজের জন্য ২২টি হ্যান্ডসেট ব্যবহার করতেন সায়গল৷ ছিল ৫০টি সিম। মৃত অথবা এলাকার বিভিন্ন ব্যক্তির নথি ব্যবহার করে সেগুলি সংগ্রহ করা হত৷ কললিস্ট ঘেঁটে সংশ্লিষ্ট জেলার ওসি-আইসিদের সঙ্গে ফোনালাপের তথ্য উঠে এসেছে। অফিসারদের দাবি, পাচার থেকে প্রাপ্ত অর্থ তুলতেন সায়গল। তার পর তা জমা পড়ত বোলপুরের ‘বাদশা’র ডেরায়। এই বেআইনি টাকা ‘খাটানো’র জন্য খোলা হয়েছিল একাধিক কোম্পানি৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *